ইস্ট বেঙ্গল সমর্থক রা এই লেখা পড়বেন না - রাগ ধরে যাবে | সোজা বাংলায় পিত্তি জ্বলেও যেতে পারে |
ভ্যাদভ্যাদে মোহন বাগান সমর্থকরাও দয়া করে আর এগোবেন না - লেখাটাকে আদিখ্যেতা মনে হতে পারে |
এ লেখা ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে সেই সব মোহনবাগানীদের জন্য যাঁরা বহুদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলার পর এই মূহুর্তে স্বপ্নের জগতে রয়েছেন - ভাসছেন আপ্লুত আবেগে গত রবিবারের বিস্ফোরক সাফল্যের পর |
"ঘটি-বাঙাল" শব্দটি ব্যবহার করলাম কারণ মোহনবাগান প্রাদেশিকতার ঊর্ধে - মোহনবাগান সারা দেশকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল | সেই আদ্যিকালে - খালি পায়ে বুট পরা সাহেবদের হারিয়ে | সেই সৈনিকদের ছজন ছিলেন পূর্ববঙ্গের - পরবর্তীকালে গোষ্ঠ পাল , চুনি গোস্বামী , সুব্রত ভট্টাচার্য প্রমুখ কিংবদন্তিও জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গীয় | তাই মোহন বাগান কেবল পশ্চিমবঙ্গীয়দের একার নয় |
খেলায় সাফল্য চিরস্থায়ী নয় | রবিবারের সাফল্য অচিরেই আবার হতাশায় পরিবর্তিত হতে পারে | বিশেষ করে যখন বসু - মিত্র - দত্ত নামের শয়তান গুলি এখনো বহাল তবিয়তে রাজত্ব করে চলেছে | এই সাফল্য এদের জন্য
নয় - ইংরিজিতে বললে " ইন স্পাইট অফ দেম " | এই সাফল্য কোচ সঞ্জয় সেনের জন্য , কোনো জাদুতে টগবগে হয়ে ওঠা হারার আগে না হারা খেলওয়ারদের জন্য | সবার ওপরে আছে দেশে বিদেশে হাল না ছাড়া লক্ষ লক্ষ সমর্থকরা - যারা মৃন্ময় দে-র ভাষায় গত রবিবার দুবার কেঁদেছে - ৪৪ মিনিট হতাশায় , তারপর বাঁধভাঙ্গা আনন্দে |
বয়স হচ্ছে তো - স্মৃতিচারণ না করে থাকতে পারি না | ফিরে যাই ২০০৪ সালে | আজকের তুলনায় আন্তর্জাল তখন নেহাতই শিশু - বর্তমান আলোকগতি সে সময়ে কল্পবিজ্ঞানের আওতায় | তবে এটা ঠিক, কোথায় যেন শোনা এক ব্যান্ডের গানের কথায় " ইমেলে যুক্ত হলো হনুলুলু হলদিয়া !" তখনও গুগল-এর জন্ম হয়নি | ইয়াহু তে "মোহন বাগান " সার্চ করে খুঁজে পেলাম জনা চল্লিশের এক ইয়াহু "গ্রুপ" | বলা বাহুল্য, সঙ্গে সঙ্গেই সদস্য হয়ে গেলাম |
সে বছর আমরা শুধু হেরেই চলেছি | তার-ই মধ্যে হাঁটুর বয়সী কিছু ঝকঝকে তরুণের সঙ্গে মোহনবাগান নিয়ে আলোচনা, স্মৃতিচারণ করে চলেছি | বিদেশের , বিশেষ করে ক্যানবেরার নিস্তরঙ্গ জীবনে সেই ভার্চুয়াল আড্ডাখানাটি আমার কাছে অন্তত ছিল মরুভূমির মধ্যে একটা ওয়েসিস - ফিরে যেতাম ষাটের, সত্তরের , আশির দশকের মেঠো গল্পে |
২০০৫ সালের অবস্থা আরও খারাপ | একেবারে অবনমনের খাদের সামনে | ততদিনে সেই ইয়াহু গোষ্ঠির কজন মিলে " গ্রিন এন্ড মেরুন " নামে একটি সংগঠন তৈরী করে ফেলেছে | আমার জানা সেটি-ই আজকের অর্থে প্রথম " ফ্যান ক্লাব " | তখন বৈদ্যুতিক যোগাযোগ আজকের মত ছিলনা - ছিল না স্মার্ট ফোন নামক যন্ত্রটিও | তাও প্রচন্ড উদ্যমে ছেলেগুলি ক্লাব কে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে | মনে আছে , রবিবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য না খেলে আমরা সেদিন টালিগঞ্জ অগ্রগামীর বিরুদ্ধে অবনমন বাঁচানোর খেলা খেলছি | বলরাম চৌধুরী তখন ক্লাবের শীর্ষ কর্তা | কোচ কে ছিলেন মনে করতে পারছি না | শুনেছি খেলার আগের কদিন গ্রিন এন্ড মেরুনের কলকাতা স্থিত সদস্যরা পাড়ায় পাড়ায় আবেদন জানিয়েছে মাঠে গিয়ে ক্লাবকে সমর্থন করার জন্য |
ওরা পেরেছিল | সেদিন আমরা চার গোলে জিতেছিলাম | খেলার পরে ত্রিনাঞ্জন সেনগুপ্ত নামে একটি চাবুকের মত ছেলে আমায় সল্ট লেকের একটা পাবলিক বুথ থেকে ফোন করে জানিয়েছিল " সিধুদা - আমরা জিতেছি | " আদতে মোহনবাগানী বিখ্যাত সাহিত্যিক মতি নন্দী মশায় দেশ পত্রিকার " এই সময় " নামে ফিচারটিতে গ্রিন এন্ড মেরুনের সেই প্রয়াসের উল্লেখ করেছিলেন | লেখাটিতে মতি বাবু ( বোধহয় অনেক দু:খে ) মোহন বাগান সম্পর্কে বেশ কিছু নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন | বলেছিলেন মোহনবাগান উত্তর কলকাতার অলস, উদ্যমহীন , মুমূর্ষু ঘটিদের প্রতিভূ | একমত হয়েও হতে পারিনি - কিন্তু আমি নিশ্চিত মতিবাবু বেঁচে থাকলে আজ আপ্লুত হতেন |
সেই গ্রিন এন্ড মেরুন বেশিদিন টেঁকেনি | পুরো ব্যাপার জানিনা - খেয়োখেয়ি, নেতৃত্বের , সুষ্ঠু সংগঠনের অভাবে অল্পদিনের মধ্যেই সাহসী কিন্তু আপাত দিশাহীন প্রচেষ্টাটির অবলুপ্তি ঘটে | কিন্তু সেটি ছিল একটি বুদ্বুদ , একটি জলকণা, যা রূপান্তরিত হয়েছে কয়েকশ ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে সুসংগঠিত ফ্যান ক্লাবে | যাদের কথা আজকাল প্রতিদিন-ই নানা সংবাদ মাধ্যমে বলা হয় | গত কদিনের আবেগের ঢেউ যাদের আন্তরিক প্রয়াসের ফল |
সেই গ্রিন এন্ড মেরুনের তরুণ বিপ্লবীদের অনেকেই আজ মাঝবয়সে | তবু উদ্যম কমেনি | ফেসবুকের মাধ্যমে সেই দলের অনেকের সঙ্গেই নতুন করে যোগাযোগ হয়েছে | কলকাতায় গেলে চেষ্টা করি দেখা করার | কয়েকজন ( যেমন মিঠুন ব্যানার্জি, শিলাদিত্য মিত্র ) হারিয়ে গেছে | নতুন অনেক মোহনবাগানীদের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে | এদের জন্য এই দূর পরবাসেও মোহনবাগানী-ই রয়ে গেছি | আছি | থাকব |